ক্লিক করুন এখানে

শিশুর খেতে অরুচি | baby refuses food

একটি শিশু জন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলেই সে যথেষ্ঠ পুষ্টিগুণ পেয়ে যায়। কিন্তু ছয় মাস বয়সের পর থেকেই তার বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় ।পরিমিত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার না খেলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।তাই খাবারকে শিশুর কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।



বাচ্চা না খাওয়ার কারণ:

শিশুদের মধ্যে কম ক্ষুধা হওয়ার সাধারণ কারণগুলি হল:

১।খাবার নিয়ে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া শিশুর না খাওয়ার (baby refuses food) অন্যতম কারণ। তাই, শিশুর মন যেন ভালো থাকে এবং অবশ্যই শিশুর পছন্দকে ও গুরুত্ব দিতে হবে।

২।ঘন ঘন খাবার দেওয়া যাবে না। এতে শিশুর বমি ও ডায়রিয়া হতে পারে। হয়।ছয় মাস বয়সের পর, শিশুকে তিন ঘণ্টা পর পর খাবার  দেওয়া উচিত। এর মাঝে অল্প বুকের দুধ দেওয়া যেতে পারে।

৩।সন্তান যদি ক্রমাগত অসুস্থ হতে থাকে, একাধিক সংক্রমণ, জ্বর হয় বা ওজন কমতে থাকে,এর ফলে তার শারীরিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়ে,ফলাফল হয় ক্ষুধামন্দা। সাধারণত জ্বর, গলা ব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কিংবা ডায়রিয়া হলে শিশুর খাবারের পরিমাণ কমে যায়। অসুস্থতা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও, ওষুধের কারনে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য কিছু সময় নিতে পারে। এই সময় শিশুর খাবার তেতো লাগতে পারে।

৪।টিভি, খেলনা,মোবাইল,শিশুর খাবারের দিকে মনোযোগ কমিয়ে দিতে পারে। তবে শিশু যদি এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে,তবে শুধু খাবারের সময়টুকু টিভি বা মোবাইল দিতে পারেন।  

৫।খাবারে এলার্জি থাকলে শিশু স্বাভাবিক খাবার খেতে চায় না। অনেক শিশুর খাবারের গন্ধ বা ধরন (যেমন বেশী শক্ত বা খাবারের  চেহারা)অপছন্দ করে ।

৬।মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণেশিশুর খাবারে অরুচি (baby refuses food) হতে পারে।  

৭।শিশুর কৃমির সংক্রমণ হলে, কৃমি পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে সেখানে পরজীবী হিসেবে অবস্থান করে। ফলে শিশুর নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে, খাবারের রুচি কমে যায়। কৃমির সংক্রমণ হলে অবশ্যই শিশুকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে।

৮।অনেক বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে শিশুকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। শিশুর যত্ন কম হয়। এতে করে বাচ্চার রুচি কমে যেতে পারে। কারন বাবা মার অবহেলা শিশুর মনে দাগ কাটে।

৯।রক্তশূন্যতা রুচি কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। রক্তশূন্যতায় ভুগলে শিশুরা দুর্বল ও ক্লান্ত থাকে। সময়মতো রক্তশূন্যতার চিকিৎসা না করালে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বড় বাধা হতে পারে।

১০।সব সময় এক রকম খাবার দেয়া, শিশুর খাবারের অনীহা (baby refuses solid food) আনতে পারে। তাই খাবারের মেনুতে বৈচিত্র্য আনুন।

১১।অনেক সময় বাচ্চার অ্যাজমা বা হাঁপানি,থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হলে খাবারে অরুচি হয়।

১২।বাচ্চার পায়খানা হচ্ছে কি না খেয়াল করুন। বদহজম, গ্যাস, পেট ফাঁপাএসবও ক্ষুধামন্দার কারণ হতে পারে।  

১৩।শিশু মানসিক চাপে থাকলে ও রুচি কমে যায় (baby refuses to eat food), ঘুম কম হয়।সাধারণত শিশুরা একা থাকলে,ভয় পেলে,  কিংবা বাবা-মায়ের কাছ থেকে কম সময় পেলে কিংবা কারো সংস্পর্শ তার ভালো না লাগলে ও মানসিক চাপে ভুগতে পারে।

১৪।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাবার গ্রহণ করা। বিশেষ করে প্রধান খাবারের আগে অতিরিক্ত হালকা খাবার দেয়া যেমন চকলেট, জুস,ফাস্ট ফুড ইত্যাদি। এতে ভাতের ক্ষুধা নষ্ট হয়।

কি করবেনঃ

১।খাবারকে সুস্বাদু করতে হবে। খাবার হতে হবে নরম,থকথকে।আর একবার দুবার শিশু খেতে না চাইলে আরো কয়েকবার চেষ্টা করুন। তবে অতিরিক্ত জোর করবেন না। এতে শিশু বমি করতে পারে।

২।শিশুদের পছন্দমতো খাবার বেছে নেয়ার সুযোগ দিন আর খাওয়ানোর সময় গল্প করুন তার সাথে।

৩।শিশুকে বিভিন্ন খাবারে আগ্রহী করে তুলতে চেষ্টা করুন এই বলে যেমন এটি অনেক মজা,তোমার বাবা অনেক পছন্দ করে বা আপুমনি বেশী খায়ইত্যাদি। রুটি, ডিম, মাছ, মুরগি, শাকসবজি, ফল সব কিছুই খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। তবে আস্তে আস্তে ও অল্প অল্প করে।

৪।ঠিক মত খাবার খেলে ঘুরতে নিয়ে যাব,অমুক জিনিস কিনে দেব বা কার্টুন/গেমস খেলতে দিব”—বলে আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন।

৫।কলা, আপেল,মাল্টা বা আনারের রস দিতে পারেন।

৬।সেরিলাক না দিয়ে তার বদলে ওটস, রুটি, সুজি, সাগু এগুলো দিন।  

৭।শিশু যদি ডিম খেতে না চায়,সেক্ষেত্রে ডিমের স্যুপ বা পুডিং,হালুয়া খাওয়ানো যেতে পারে।

৮।দুধ না খেতে চাইলে,এরবদলে পুডিং,সেমাই,মিষ্টি,ছানা,দই দিতে পারেন।

৯। প্রতিদিন অল্প করে শাকসবজি,, ডিম,চিকেন ফ্রাই বা কাবাব করে খিচুড়ি আকারে খাওয়াতে পারেন। নুডলস করলে তাতে ডিম, মাংস, চিংড়ি, সবজি দিন। মাছ না খেলে মাছের বড়া বানিয়ে শিশুকে খেতে দিন।

১০।শিশুর বয়স ৬ মাস হয়ে গেলে বুকের দুধ আগের তুলনায় কমিয়ে আনতে হয়। দুধের পাশাপাশি হালকা শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করতে হবে।

১১।লেবু বা লেবর রস দ্রুত ক্ষুধা তৈরী করতে পারে। আপনি আপনার সন্তানের জন্য লেবুর রস তৈরি করতে পারেন।যে কোন খাবারে ও মিশিয়ে দিতে পারেন।ফলের মধ্যে বরই ও ক্ষুধা বৃদ্ধির জন্য পরিচিত। পিচ ফল সুস্বাদু এবং আপনার শিশুর ক্ষুধা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। সুযোগ পেলে বাচ্চাকে দিতে ভুলবেন না।

১২।শিশুকে একা খাওয়ানো হলে যত টুকু খাবে তার চেয়ে বেশী খাবে যদি সপরিবারে বসে খাওয়া হয়।ঘরে কেউ না থাকলে কমপক্ষে মা যেন বসেন। এতে শিশু দেখে দেখে ও খেতে উৎসাহ পাবে।

১৩।চিনাবাদামে ও আছে ক্ষুধা বৃদ্ধির গুন।বাচ্চার মাখন পছন্দ হলে এর জায়গায় পিনাট মাখন দিতে পারেন ব্রেডের সাথে।গাজর রস ও একই গুনের অধিকারী।গাজরের হালুয়া করে দিতে পারেন আপনার সোনামনিকে।  

১৩।খাবার পরিবেশনে নতুনত্ব আনলেও শিশুর আগ্রহ বাড়তে পারে যেমনঃ নতুন বাটি,প্লেইটবা রঙিন পাত্রে খাবার পরিবেশন করুন।

১৪।দই একটি ভাল পাচকতন্ত্র উদ্দীপক খাদ্য। এঁর সাথে মেথি বীজ গুড়া বা পুদিনা পাতার রস সামান্য লবন দিয়ে মিশিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ান। এ ক্ষেত্রে আপনার বাচ্চার বয়স যেন এক বছর বা বেশী হয়।

১৫।বাচ্চাকে খেলাধুলা এবং অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়াকলাপে জড়িত হতে উৎসাহিত করুন। পরীশ্রম করলে পাচক সিস্টেম উদ্দীপিত হয়,ক্ষুধা বাড়ে। বাচ্চাকে সকাল বা বাইরে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন।

১৬।খাওয়াবার সময় যেন খুব বেশী না হয়। মোটামুটি ২০- ৩০ মিনিটের মধ্যে বাচ্চা যেন খাওয়া শেষ করতে পারে। বেশি সময় ধরে খাওয়ালে শিশুর মধ্যে অরুচি তৈরির পাশাপাশি হজমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আপনার সন্তান বেশী সময় নিয়ে খেলে আস্তে আস্তে সময় কমিয়ে আনুন। তাড়াহুড়া করবেন না।

১৭।জিঙ্কের ঘাটতি থাকলে আপনার সন্তানের ক্ষুধা কম হতে পারে। খাবারের তালিকায় মাংস,যে কোন ধরনের বাদাম,রসুন, মাশরুম, ব্রকল্লি,ডিম,দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি খাওয়ানোর মাধ্যমে এর স্তরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে।

১৮।চারপাশের তাপমাত্রা ও পরিবেশগত অবস্থা শিশুদের ক্ষুধাকে প্রভাবিত করে। যেমন গ্রীষ্মে শিশুর খাওয়ার চাহিদা কমে যায় আর শীতকালে সহজেই ক্ষুধা অনুভূত হয়।

১৯।শিশুর মন ভালো না থাকলে খিদে নষ্ট হয়ে যায়। যেমন তাকে জোর করে খাওয়াতে গেলে,খেলতে না দিলে,মোবাইল না দিলে শিশু খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই খাওয়ার আগে শিশু যেন হাসিখুশি থাকে সেটা খেয়াল করুন।

২০।বাচ্চা ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি না,ওজন ঠিক আছে কি না,শরীরে পুষ্টির ঘাটতি আছে কি না বা তার আচার আচরনে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর দিন। দরকার হলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।

কি করবেন না

১। কোনোভাবেই শিশুকে খাওয়া নিয়ে বকা দেবেন না বা মারধর করা যাবে না। তাহলে খাওয়ার প্রতি অনীহা চলে আসবে।

২।শিশু ক্লান্ত ও দুর্বল থাকলে খেতে দিবেন না। একটু সময় দিন।

৩।শিশুকে চকলেট, জুস,চিপস,চকলেট প্রধান খাবারের আগে দেয়া যাবে না।এতে খিদে নষ্ট হয়।

৪।আপনার অপছন্দের খাবারের কথা শিশুর সামনে বলবেন না।

৫।শিশুর খাবারে testing salt বা আলাদা লবণ দেবেন না। আর শিশুর ঠাণ্ডা লাগলে চা খেতে দেবেন না।

৬।একবার খাবার হয়ে গেলে শিশুকে অন্যান্য খাবার দেবেন না। যেমন: ভাত খাওয়ার দুই ঘণ্টা আগে দুধ বা অন্য নাশতা দেবেন না।

জেনে রাখুন

১।বাচ্চার প্রতিদিন ওর প্রস্রাব,পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে কি না খেয়াল করুন।।বাচ্চা নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করলে দিনে একবার বা দুই বার পায়খানা করতে পারে।

২।জিনগতভাবে শিশুর বাবা-মায়ের গঠন যেমন,বাচ্চার ও তেমনই হবে। তাই বাচ্চা মোটা না চিকন এটা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে দেখুন সে সুস্থ আছে কি না,ওজন বয়স অনুযায়ী ঠিক আছে কি না, বৃদ্ধি ঠিকঠাক হচ্ছে কি না।  

৩।মনে রাখবেন আপনার শিশুর নাস্তার পরিমাণ মূল খাবারের চেয়ে সবসময় কম হতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই

If you have any doubts please let me know

Blogger দ্বারা পরিচালিত.