স্মৃতিশক্তি বাড়াবেন কিভাবে | boost memory power
মস্তিষ্কের ক্ষমতা শারীরিক ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী।প্রখর স্মৃতিশক্তি, দ্রুত চিন্তা করা ও শিখতে পারার দক্ষতা – যে কোনও মানুষের সফলতার পথকে সুগম করে তুলতে পারে। তবে বয়সের সাথে সাথে একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা কমতে থাকে, স্মৃতি শক্তি দূর্বল হতে থাকে। তবে নিয়ম মেনে স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করলে ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করলে বয়সজনীত মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া বিলম্বিত করা অনেকাংশে সম্ভব।
কি
করবেনঃ
১। নিয়মিত শরীরচর্চা মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধিতে
সাহায্য করে।প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট শরীরচর্চায় স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে
দেয়। সেই সাথে আপনার দৈনন্দিন কাজ ও পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পাবে।
২।শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখতে ঘুমের ভূমিকা অপরিসীম।রাতে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে তা বার্ধক্য প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে মস্তিষ্কে বাঁধার সৃষ্টি করে আবার আর ১০ ঘণ্টার
বেশি ঘুম হলে ও মস্তিষ্ক সজাগ ও সতেজ হওয়ার সময় পায় না।তাই মস্তিষ্কের সুস্থতার
জন্য বয়স অনুযায়ী পরিমিত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
৩।স্মৃতিশক্তিকে ধারালো করার দারুন একটি মাধ্যম হল গণিত
চর্চা করা।বেশী চাপ নেয়ার দরকার নেই। অবসর সময়ে ছোট ছোট পাটিগণিত বা বীজগনিত অংকের
চর্চা করুন অথবা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে লজিক্যাল গেম বা এ্যাপও নামিয়ে ও নিতে পারেন।মূল
কথা হল গণিত চর্চা করলে বুদ্ধির ব্যয়াম হয়, চিন্তা করার দক্ষতা বাড়ে ।
৪।যেটি আপনি খুব ভালো পারেন, সেটা অন্যকে অন্যকে শেখানো--স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কৌশল। একই বিষয় বারবার পড়ানোর কারনে তথ্য গুলো স্মৃতিতে স্থায়ী ভাবে জায়গা করে নেয় ও ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনে অনেক কমে যায়।
৫।নতুন কিছু শেখা মস্তিষ্কের চিন্তা ভাবনার প্যাটার্ণকে উন্নত করে। যে কোন কাজে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করলে চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। আপনার প্রতিদিনের কাজে বা কাজ করার পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনুন। নেতিবাচক চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।এর ফলে ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে শতকরা ৭৫ ভাগ।
৬।যে কোন পড়া বসে না পড়ে হেঁটে হেঁটে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্ত হয়।বসে পড়ার তুলনায় হেঁটে পড়লে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কিছুটা বেড়ে যায়। এটি বিভিন্ন গবেষনায় প্রমানিত।
৭।মেডিটেশন মস্তিষ্কের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে। মনোযোগ বৃদ্ধিতে এই প্রক্রিয়া বেশ কার্যকরী।
৮।হাসিখুশি বা আনন্দে থাকা মস্তিষ্কের কাজ ঠিকমত
হওয়ার জন্য খুবই জরুরী। হাল্কা মেজাজে থাকলে স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধি ভালো কাজ
করে। যারা সব সময়ে হাসিখুশি থাকেন তারা যে কোনও বিষয় দ্রুত বুঝতে বা শিখতে
পারেন।বন্ধু বান্ধব বা কাছের মানুষদের সাথে সময় কাটানো বা বিনোদনের মধ্যে থাকলে মস্তিষ্ক
চাঙ্গা থাকে।
৯।একটি জিনিস
বারবার শিখলে মস্তিষ্কের নিউরোন শক্তিশালী হয়। তখন ভুলে যাবার সম্ভাবনা ও অনেক কমে
যায়। তাই কোনও কিছু ভালো ভাবে শিখতে হলে বারবার প্রাকটিস করতে হবে।
১০।প্রতিদিন পায়ের
আঙুল গুলো ম্যাসাজ
করুন৷ এই
ম্যাসাজ মস্তিষ্কের
কোষের সাথে
যোগাযোগ স্থাপনে
সহায়তা করে৷তবে
নিয়মিত করতে হবে ৫-১০ মিনিট প্রতিদিন।
১১।দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ মস্তিষ্কের জন্য খুবই
ক্ষতিকর। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক
রাখতে নিজেকে স্ট্রেস থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। মস্তিষ্ককে অবসর দেয়াটা ও দরকার, তাতে কাজে সতেজতা ফিরে আসবে ও দেহ-মন
চাঙা হবে।
কি খাবেনঃ (
মস্তিষ্কের গঠন ও
উন্নতির জন্য প্রয়োজন উপযোগী খাবার গ্রহণ করা। চলুন এ রকম কিছু খাবারের সাথে
পরিচিত হই।
১। মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া বিষাক্ত উপাদান অপসারণে,মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে কফি অনেক বড় ভূমিকা রাখে। এমনকি নতুন কোনো ঘটনাকে মনে রাখাতেও কফির সহায়ক ভূমিকা রয়েছে। তবে দিনে দুই কাপের বেশী কফি খাবেন না।
২। জামে প্রচুর ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ থাকে যা মস্তিষ্কের বয়সজনীত
ক্ষয় কমাতে বিশেষ উপকারী। তাছাড়া জামে আছে ‘অ্যান্থোসায়ানিন’ মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা সুরক্ষিত রাখতে অত্যন্ত
কার্যকর।
৩। ম্যাগনেসিয়াম এমন একটি খনিজ
যা শরীরের অসংখ্য দৈনিক
কার্যাবলী সম্পাদনে এটি খুব
জরুরি। মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতা উন্নয়ন,মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি,প্রভৃতি কাজে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে
এই উপাদান। সবুজ পাতা বিশিষ্ট শাক সবজি,বাদাম,কুমড়ার বীজ, দুধ ইত্যাদি মাগনেসিয়ামের উল্লেখযোগ্য উৎস।
৪।ডিম মস্তিষ্কের
গঠন বজায় রাখতে ও মনযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
৫।শরীরে পানির
অভাব মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে দূর্বল করে দেয়। তাই যথেষ্ঠ পরিমান পানি পান
করলে,মস্তিষ্ক সতেজ থাকে।
৬।মস্তিষ্কের মূল
শক্তি যোগায় গ্লুকোজ।এই কারনেই মিষ্টি জাতীয় খাবার বিশেষ করে চকলেট খেলে মস্তিষ্কে
ডোপামিন নামের হরমোন তৈরী হয়, যা মনে রাখার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে। মস্তিষ্কের
রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তিকে
শক্তিশালী করা ও নিউরন’কে সুরক্ষিত
রাখার পেছনে ডার্ক চকলেটের উপকারী ভূমিকা আছে। এতে প্রায় ৭০ শতাংশ কোকো থাকে।
৭।ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড স্বাস্থ্যকর ব্রেন
কোষ তৈরীতে ভূমিকা রাখে। এর উৎকৃষ্ট উৎস হল সামূদ্রিক মাছ,বাদাম, সয়াবিন
তেল,ইত্যাদি।
৮।মধু স্নায়ুকে শিথিল করে এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। স্মৃতি একত্রীকরণে ভূমিকা রাখে।
৯। আঁশ জাতীয় খাবার ফল, শাক, সবজি অন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আর যেহেতু মস্তিষ্ক আর অন্ত্র গভীরভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, তাই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে অন্ত্রের ‘মাইক্রোবায়োম’য়ের ভারসাম্য নষ্ট হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে মস্তিষ্কে।
১০। ফার্মেন্টেড’ বা ‘প্রোবায়োটিক’ খাবার যেমন দই মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যে ভূমিকা রাখে ।
কি করবেন নাঃ
১। ধূমপান, মদ্যপান হার্ট,ফুস্ফুস, কিডনীর সাথে সাথে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাকে দূর্বল করে দেয়।
২। অনিয়মিত ঘুম বা অধিক ঘুম স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়।
৩। মানসিক অশান্তি, পরিবারে অবহেলা ইত্যাদি দূর্বল স্মৃতিশক্তি বা স্মৃতিভ্রমের কারন হতে পারে।
শিশুদের মনে রাখার শক্তি বৃদ্ধির কৌশলঃ
১।পাঠ্যপুস্তকের
বাইরে শিশুর জ্ঞান বাড়ানোর জন্য বই কিনে দিন।শিক্ষামূলক ফিল্ম দেখাতে পারেন। অনলাইনে বিভিন্ন নৈতিক শিক্ষামূলক ভিডিও,কার্টুন
দেখাতে পারেন।লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে বই দেখাতে পারেন।উদ্দেশ্য হল আপনার সন্তান যেন
শিখতে পারে।
২।
শিশুকে প্রশ্ন করতে শেখান।এর ফলে তার মধ্যে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। যেমন কোথাও বেড়াতে
গেলে তাকে জিজ্ঞেস করুন,সে কিছু জানতে চায় কি না অথবা তার ভালো লাগছে কি না।পরে এ ব্যপারে তাকে প্রশ্ন করুন।দেখুন সে কত টুকু মনে রাখতে পেরেছে।
৩।
তাকে বন্ধু তৈরীতে উৎসাহিত করুন।স্কুলের হোক আর প্রতিবেশী হোক। স্কুল থেকে আসলে জিজ্ঞেস
করুন আজ কি করল স্কুলে,বন্ধুর সাথে কি কথা হল বা কি খেলল ইত্যাদি।
৪।শিশুকে
কোন কিছু শেখানোর সময় উদাহরন টানুন, গল্পের আশ্রয় নিন বা ছবির ব্যবহার করুন। তা হলে
শিশু সহজে মনে রাখতে পারবে।
৫।শিশুকে
বিভিন্ন শিক্ষামূলক জায়গায় নিয়ে যান।দেখে দেখে বাচ্চারা সবচেয়ে সহজে শিখতে পারে। যেখানে
যাবেন,সে সন্বন্ধে তাকে অল্প বিস্তর তথ্য জানান। ভ্রমনে শিশুর অভিজ্ঞতা বাড়বে,সমাজ,
সংস্কৃতি,ঐতিহ্য—এসব চিনতে পারবে।
৬।বিখ্যাত
লেখক,বিজ্ঞানী,গবেষক বা বীর যোদ্ধাদের গল্প শোনান বাচ্চাকে।তার মনে বিখ্যাত ব্যক্তির
আদর্শের ছাপ কিছুটা হলে ও পড়বে।
৭।বিভিন্ন
বিষয়ে শিশুর সঙ্গে আলোচনা করুন। তাদের ভাবনা সম্বন্ধে জানুন। তার প্রিয় বিষয় নিয়ে কথা
বলুন।
৮।যে
কোন পড়াকে সে যেন চাপ না ভাবে, বরং গম্প করে একটি আবহ তৈরি করুন।পড়ার মাঝে একটু মজা
করুন।বিরতি দিন।সে যেন আনন্দে শিখে, তার কাছে পড়তে বসা যেন ভয়ের কারন না হয়।
৯।সব শিশুর স্মৃতিশক্তি সমান না। যারা পড়াশোনায় দূর্বল, তাদের ভর্ৎসনা করবেন না,বকা দেবেন না বরং আরো বেশী সময় দিন।
১০।শরীরচর্চায় শরীর ও মন দুই-ই ভালো থাকে। বাচ্চাকে নিয়ে হাসি খেলায় রোজ হালকা ব্যয়াম করাতে পারেন।জেনে রাখুনঃ এই ইন্টারনেট ও টেকনোলজির যুগে, তথ্য সংরক্ষন পদ্ধতি সম্বন্ধে যথেষ্ঠ জ্ঞান আপনাকে অনেকটা সাহায্য করতে পারে। আজকাল ইচ্ছে করলেই পেন ড্রাইভে, পোর্টেবল হার্ড ড্রাইভে দরকারি তথ্য রাখা যায়। তাছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে ও তথ্য রাখা যায়। যেমন আপনার প্রয়োজনীয় পাসওয়ার্ড, পিন কোড, কার্ড নম্বর, ব্যাংক একাউন্ট তথ্য ইত্যাদি মনে রাখার কোন দরকার নেই। ইচ্ছে করলে আপনি গুগল ড্রাইভে ও রাখতে পারেন।
তবু, টেকনোলজি যতই উন্নত হোক, মানুষ হিসেবে আপনার প্রখর স্মৃতিশক্তি ও দৃঢ় চিন্তা করার ক্ষমতা আপনাকে নিঃসন্দেহে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই
If you have any doubts please let me know