নবজাতকের ডায়রিয়া | Babies with diarrhea
শিশুরা এক ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে, স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে বাচ্চার পরিচর্যা করলে ডায়রিয়া রোধ করা সম্ভব।
কেন হয় (
১।ভাইরাস (রোটা,এডিনো,ক্যালিসি),ব্যাক্টেরিয়া (সালমোনেলা),ছত্রাক বা কৃমি থেকে।
২।অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও পরিষ্কার
পরিচ্ছন্নতার অভাব।
৩।বিশুদ্ধ খাবার পানি পান না করা-একটি বড় কারন ডায়রিয়া হওয়ার। এছাড়া শিশুর খাদ্য সরঞ্জাম (নিপুল, প্লেইট,বোতল)ঠিক ভাবে না ধোয়া ইত্যাদি শিশুর ডায়রিয়া ( (babies with diarrhea) হওয়ার জন্য দায়ী।
৪।এন্টিবায়েটিক ঔষধ সেবনের প্রভাবে ডায়রিয়া
হতে পারে।
৫। শিশু হামাগুড়ি দিতে এবং হাটতে শেখার
সময় বিভিন্ন ময়লা বা নোংরা আর্বজনার সংস্পর্শে আসে।সে তখন স্বভাববশতঃ হাত মুখে দেয়
এবং হাত মুখে দেয়ায় জীবানু পেটে গিয়ে ডায়ারিয়ার আক্রান্ত হয়।
৬। শিশুদের অনেক সময় বিশেষ কোনও খাবারে
অ্যালার্জি থাকায় সেই খাবার হজম করতে পারে না। যার ফলে গ্যাস,পেট ব্যাথা ডায়রিয়ার
লক্ষন দেখা দিতে পারে।
৭।গরমকালে বাচ্চার ডায়রিয়ার ঝুঁকি বাড়ে,ডিহাইড্রেশনের
সমস্যা দেখা দেয়।ডায়রিয়া ও হতে পারে। তাই গরমে বাচ্চাকে তগরম থেকে দূরে রাখুন ও প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ান।
লক্ষন কিঃ
১। শিশু দিনে ২-৫ বার তার চেয়ে বেশী পানির মতো পায়খানা (loose stool) করবে।পায়খানা হবে পানির মতো পাতলা ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়। সঙ্গে অল্প মিউকাস (Mucus in baby poop) থাকতে পারে।
২।জ্বর,নাক দিয়ে পানি পড়া বা সর্দি, হাঁচি, কাশি ইত্যাদি থাকতে পারে।
৩।মলের রং (Baby poop color) হলুদ, সবুজ বা বাদামী বর্ণের হতে পারে।
৪।বারবার বমি হতে পারে।
৫।খাবারের রুচি কমে যাবে, শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।
৬। চোখ বসে যাবে,প্রস্রাব গাঢ় হলুদ হতে পারে।
৭। ত্বক শুষ্ক ও ঢিলে দেখায়।
৮। শিশু নিস্তেজ হয়ে গেলে বা তার প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।
কি করবেনঃ
১। ডায়রিয়ার সময় শিশুর যেন পানিশূন্যতা না হয়,সে জন্য প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর
শিশুকে বয়স এবং ওজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার স্যালাইন ধীরে ধীরে খাওয়াতে
হবে। শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হলে শুধু বুকের দুধ এবং ছয় মাসের বেশি হলে বুকের দুধের
সাথে বাসায় রান্না করা স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে।
২।খাবার তৈরীর আগে এবং শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে,বাচ্চার
ডায়াপার পালটানোর পর প্রতিটি ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালো ভাবে হাত ধুয়ে নিন। খাওয়া শেষ হলে শিশুর মুখ
ভালো করে ধুয়ে দিতে ভুলবেন না।
৩।শিশুকে বহিরাগত,অসুস্থ লোক থেকে দূরে রাখুন।
৪। শিশুদের হাত,পায়ের নখ
নিয়মিত কেটে দিন।
৫।বাচ্চার আশপাশ এবং তার খেলনা পরিচ্ছন্ন
করে রাখুন।
৬। খাবার পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে
পান করান। রান্নাতে ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার করুন।
৭।শিশুর বয়স
দুই বছরের কম হলে ১০ থেকে ২০ চামচ; দুই বছরের বেশি হলে ২০ থেকে ৪০ চামচ স্যালাইন
প্রতিবার মলত্যাগের পর দিতে হবে। যদি বমি হয়, তবে ১০ মিনিট অপেক্ষার পর আবার
স্যালাইন দিন।ছয় মাসের কম বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে বুকের দুধ বন্ধ করবেন
না।
৮। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে বুকের
দুধের পাশাপাশি অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার যেমন ভাতের মাড়,ডাবের পানি,কাঁচা কলার ভর্তা,বার্লি বা জাউভাত সবজি মিশিয়ে
দিতে পারেন। সারাদিন কমপক্ষে ছয়বার, অর্থাৎ তিন-চার ঘণ্টা পর পর শিশুকে খাবার দিন।
প্রতিবারা অল্প করে দিলে শিশুর পক্ষে খাবার হজম করা সহজ হবে।
৯।প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন তৈরি
করুন। খাবার ফ্রিজে রেখে শিশুকে খাওয়াবেন না।
১০।কোল্ড ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে শীতের
সময় শিশুকে পর্যাপ্ত গরম পোশাকে ঢেকে রাখুন।
১১। দুই বছরের বেশী বয়সের শিশুকে গরুর
দুধ দিলে, ঘন না করে বরং একটু পাতলা করে পান করান।
১২।জ্বর থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী
প্যারাসিটামল-জাতীয় জ্বরের সিরাপ, ঠাণ্ডার জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপও দিতে
পারেন।
১৩।শিশুকে সময়মতো সবগুলো টিকা দিতে হবে।
একটি ও যেন বাদ না যায়।
ঘরোয়া প্রতিকার (
শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল,তাই সহজেই
ডায়রিয়া বা যে কোন রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে । চলুন,ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য
ঘরোয়া কিছু উপায় জেনে নাই।
১। আপেল শিশুর পায়খানাকে শক্ত করতে সাহায্য করে।
এটিকে পিষে নরম করে বাচ্চাকে খেতে দিন। হজমের পাশাপাশি শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি
ও সরবরাহ করবে ।
২।দই ও ইয়োগার্ট শিশুর পাচনতন্ত্রের জন্য খুব উপকারী।
তবে শুধু ঘরে তৈরী দই দেবেন। কিন্তু তাতে চিনি মেশাবেন না। শিশুর ডায়রিয়া দই খুব
উপকারী। আর একটু দইয়ের সাথে কলা খেলে ও পেট খারাপে
দারুন উপকার পাবেন।
৩।বাচ্চার বয়স ১ বছরের বেশী হলে গাজরের রস দিতে
পারেন। পেটের জন্য এই রস খুব ভালো।
৪।কলাতে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম,ক্যালসিয়াম,ভিটামিন(“এ”
ও “বি৬”)থাকে যা শিশুর দূর্বলতা কাটিয়ে শরীরকে চাঙ্গা
করে তুলতে পারে।
৫।এক চা-চামচ মধুর সাথে এক চা-চামচ আদা ও একটু দারচিনি
গুড়া ও জিরা গুড়া মিশিয়ে বাচ্চাকে অল্প অল্প করে দিন। কারন আদা পরিপাকে খুব উপকারী
এবং ডায়রিয়ায় কার্যকরী।
৬। এক বাটি মুড়ি এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে রাখুন ১৫-২০ মিনিট।এরপর শুধু মুড়ির পানি ছেকে নিয়ে সেই পানি খাওয়ান আপনার শিশুকে, দিনে দুইবার।
৭।এক কাপ লাল মুসুর ডাল জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করুন।
সেখান থেকে শুধু পানিটুকু ছেঁকে আলাদা করে আপনার শিশুকে খাওয়ান।এই মসুর ডাল “সুপার ফুড” নামে ও পরিচিত। এটি প্রচুর প্রোটিন সমৃদ্ধ।
৮।লেবুর রসে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ভরপুর
থাকে। দিনে ৪-৫ বার এক চামচ করে লেবুর রস শিশুর ডায়রিয়া এবং অন্যান্য পেটের সমস্যার
উপশম করতে পারে ।
৯।পুদিনাতে ও আছে প্রচুর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান।এক
চামচ পুদিনার রসে এক চা-চামচ মধু ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করে ভালো করে মিশিয়ে
নিন। তারপ আপনার শিশুকে দিনে দুই থেকে তিনবার দিতে পারেন।তবে বাচ্চার বয়স দুই বছরের
কম হলে এটি দেবেন না।
১০।আলুতে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ বা স্বেতসার আছে,
যা পেটের সমস্যায় দ্রুত কাজ করে। একটি আলু সিদ্ধ করে, এটিকে বেটে তাতে এক চিমটি লবন
দিন। এই আলু মাখা দিনে একবার দিলেই হবে। তবে গ্যাসের সমস্যা থাকলে তাতে একটু জিরা
গুড়া ভেজে নিয়ে মিশিয়ে দিন।
১১।ডাবের পানি শিশুকে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি দিতে একটি
চমৎকার পানীয়। এটি শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া তরল পূরন করতে সাহায্য করে। আপনার বাচ্চাকে
দিনে ২-৩ বার দিতে পারেন।
কি করবেন নাঃ
১। শিশুকে
চিনি মেশানো ফলের রস, কোমল পানীয় বা জুস দেবেন না।
২। যেহেতু রান্নার দুই ঘন্টা পর,খাবার
আর নিরাপদ থাকে না, তাই খাবার ফ্রিজে বা জমিয়ে রেখে পরে আর শিশুকে দেবেন না।
৩। বমি হলে ও স্যালাইন বন্ধ করবেন না। বমি
বন্ধ হলে একটু অপেক্ষা করে অল্প অল্প করে স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করুন।
৪। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ
দেবেন না।
৫। শিশু মায়ের দুধ খেলে অনেক সময় বারবার পাতলা পায়খানা (Newborn babies diarrhea) হতে পারে। এর রঙ সবুজ বা ফেনা ফেনা ধরনের বা শ্রেফ পাতলা পানি মত হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে ও বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করবেন না।
কখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেনঃ
১। দীর্ঘদিন ধরে ডায়রিয়া না কমলে (১৪ দিন বা বেশী)এবং পায়খানার সাথে রক্ত গেলে।
২। শিশু অতিরিক্ত দূর্বল বা নিস্তেজ
হয়ে পড়লে,ওজন দ্রুত কমতে
থাকলে ।
৩। খিঁচুনী হলে।
৪। বাচ্চার বয়স ৩ মাস বা কম হলে,আর
দিনে দুই থেকে তিনবার পাতলা পায়খানা করলে এবং এভাবে ২-৩ দিন চলতে থাকলে ।
৫।প্রস্রাবের পরিমাণ কমে
গেলে বা একেবারেই প্রস্রাব না হলে।
৭।খুব বেশি বমি করলে,স্যালাইন বা অন্য
কোনো খাবার একেবারে খেতে না পারলে।
৮।পায়খানার সাথে রক্তে গেলে ।
৯।২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে।
১০। পেট ফুলে গেলে।
জেনে রাখুনঃ
১।ডায়রিয়ায়
পানিশূন্যতা খুবই মারাত্মক। বাচ্চা যেন সবসময়ই পর্যাপ্ত পানি বা পানি জাতীয় খাবার
গ্রহন করে।
২।খেয়াল করুন শিশুর ওজন কমে যাচ্ছে কি না,শিশুর খাদ্যে যথেষ্ঠ ভিটামিন, আমিষ,ক্যালরি আছে কি না।
৩। বাচ্চার পায়খানা নরম হওয়া মানেই কিন্তু ডায়রিয়া নয়, তবে সে যদি বারবার পায়খানা করে এবং তা প্রতিবারই তরল পানির মতো হয়, তাহলেই যেটা ডায়রিয়া।
৪।ডায়রিয়া,ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ১২ ঘণ্টা থেকে পাঁচ দিন পর ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। ও সাধারনত তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
৫। বাংলাদেশে প্রতিবছর
প্রায় ১,২৫০০০ শিশু পাতলা পায়খানায় মারা যায়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শিশু। বিশেষ করে দুই
বছরের কম বয়সী শিশুর আক্রান্তের হার খুব বেশী।

কোন মন্তব্য নেই
If you have any doubts please let me know